সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৮ পূর্বাহ্ন
নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি, কালের খবর : নারায়ণগঞ্জে ভোলানাথ জুয়েলার্সের মালিক প্রবীর ঘোষ নিখোঁজের ২১ দিন পর নারায়ণগঞ্জের কালিরবাজার থেকে তার লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তিনটি সিমেন্টের ব্যাগে ভর্তি পাঁচ টুকরো লাশ উদ্ধার হলেও হাঁটুর নিম্নাংশ উদ্ধার হয়নি। সোমবার রাত ১১টার দিকে শহরের ১৫ আমলাপাড়া কেসি নাগ রোডের রাশেদুল ইসলাম ওরফে ঠান্ডু মিয়ার বাড়ির সেপটিক ট্যাংকের ভেতর থেকে লাশের টুকরো উদ্ধার করা হয়। ওই বাড়িতে ভাড়া থাকে নিহত প্রবীরের ঘনিষ্ঠবন্ধু পিন্টু দেবনাথ। যাকে বাইপাস অপারেশন করাতে আর্থিক ও শারীরিকভাবে সহযোগিতা করেছিল প্রবীর ঘোষ। সেই বন্ধুই বাসায় ডেকে নিয়ে প্রবীরকে হত্যার পর নৃশংসভাবে লাশ টুকরো টুকরো করে সেপটিক ট্যাংকে ফেলে রাখে।
এ ঘটনায় নির্বাক স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। পুলিশ পিন্টু দেবনাথ (৪৭) ও তার এক সহযোগী বাপন ভৌমিক ওরফে বাবু (২৭) কে গ্রেপ্তার করেছে। ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে মঙ্গলবার দুপুরে তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।
বন্ধু যখন ঘাতক : পুলিশ ও পরিবারের তথ্যমতে, প্রবীর ঘোষ, পিন্টু দেবনাথ, উত্তম ও গোপী এই চারজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা সবাই কালিরবাজারে জুয়েলারি ব্যবসা করে। কিছুদিন আগে ভারতের কলকাতায় পিন্টু দেবনাথের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। প্রবীর ঘোষ নিজেই ভারতে পিন্টুর চিকিৎসার জন্য সব সহযোগিতা করেন। পুলিশ জানায়, প্রবীর ঘোষের এক ভাই সৌমিক ঘোষ ইতালি প্রবাসী।
সেখান থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পাঠানো হয় প্রবীর ঘোষের কাছে। দীর্ঘদিন ধরে ওই টাকা লেনদেন হতো প্রবীর ও পিন্টুর মধ্যে। ভাইয়ের দেয়া টাকা নিয়েই প্রবীর ও পিন্টু স্বর্ণ এবং সুদের ব্যবসা করছিলেন। এই টাকার একটি বিশাল অংশ পিন্টুর কাছে গচ্ছিত ছিল। সম্প্রতি সৌমিক ঘোষ দেশে আসে। আর তখন থেকেই নিখোঁজ প্রবীর। সৌমিক দেশে আসার আগেই টাকার জন্য পিন্টুকে চাপ দিতে থাকে প্রবীর। এসব নিয়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয়। পরে পরিকল্পনা করেই ১৮ই জুন রাত ৯টার দিকে মোবাইল ফোনে প্রবীরকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায় পিন্টু। ভাড়া বাসায় নিয়ে প্রবীরকে হত্যা করে পিন্টু ও তার দোকানের কর্মচারী বাপন ভৌমিক। এরপর বাসার নিচে সেপটিক ট্যাংকে লাশ ব্যাগে করে ফেলে দেয়া হয়। প্রিয় ভাই হারিয়ে শোকে মুহ্যমান ইতালি প্রবাসী ছোট ভাই সৌমিক ঘোষ বলেন, আমি আমার ভাই হত্যার বিচার চাই। ওরা মানুষ না। মানুষের আড়ালে নরপিচাশ।
হত্যাকারীদের যেন বাংলাদেশের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হয় এটাই এখন আমাদের চাওয়া।
গ্রেপ্তার পিন্টু দেবনাথ কুমিল্লার মেঘনা থানার চন্দনপুর এলাকার মৃত সতীশ দেবনাথের ছেলে। নারায়ণগঞ্জ শহরের ১৫ আমলাপাড়া কেসি নাগ রোডের ঠান্ডু মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকে। আর বাপন ভৌমিক ওরফে বাবু (২৭) দাউদকান্দি থানার ঠেটালিয়ার কুমদ ভৌমিকের ছেলে। সে কালিরবাজার কাজী ভবনে ‘মা স্বর্ণ শিল্পালয়ে’ কাজ করে।
যেভাবে ধরা পড়ে দুই ঘাতক : মামলা তদন্তকারী সংস্থা ডিবি জানায়, ১৮ই জুন রাত সাড়ে ৯টা থেকে প্রবীর ঘোষ নিখোঁজ হয়। ১৯শে জুন তার পরিবার নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি জিডি করেন। পরে প্রবীর ঘোষের মুক্তিপণ বাবদ টাকা দাবি করা হলে পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি অপহরণ মামলা করা হয়। মামলাটি ডিবিকে দেয়া হয়। এদিকে পিন্টু ঘটনাটিকে ভিন্নখাতে চালিয়ে দেয়ার জন্য প্রবীরের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি কুমিল্লার সীমান্ত এলাকায় রেখে আসে। পরে ওই মোবাইলটি সীমান্ত এলাকায় ব্যবহার হওয়ার সন্ধান পায় পুলিশ। পিন্টু একপর্যায়ে প্রবীরের মোবাইলে তার সিম ঢুকিয়ে ৮৭ বার কথা বলে প্রবীরের পরিবারের সঙ্গে। এমনকি প্রবীরের সন্ধান চেয়ে ব্যবসায়ীদের সব আন্দোলন, প্রতিবাদ, মানববন্ধনে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত ছিল পিন্টু। কেউ বুঝতেও পারেনি প্রবীরের ঘাতক তাদের সঙ্গেই আছে। এদিকে ক’দিন আগে পিন্টু প্রবীরের মোবাইল ফোনটি বাপনকে ব্যবহার করতে দেয়। পরে মোবাইল ট্র্যাকিং করে মোবাইলের আইএমইআই নাম্বারের সূত্র ধরে প্রবীর ঘোষের মোবাইলসহ বাপনকে আটক করে ডিবি। বাপন ভৌমিক ডিবিকে জানায়, পিন্টু তাকে এ মোবাইল ফোনটি ব্যবহার করতে দিয়েছে। এরপর আটক করা হয় পিন্টুকে। দুই দিন ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে পিন্টু প্রবীর ঘোষকে হত্যার কথা স্বীকার করে এবং লাশের সন্ধান দেয়। তাদের তথ্যমতে, প্রবীর ঘোষের পাঁচ খ- মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
চার কারণ উদঘাটনে পুলিশ : এদিকে পুলিশ প্রবীর ঘোষের ঘাতক পিন্টু দেবনাথ ও তার কর্মচারী বাপন ভৌমিককে গ্রেপ্তার করলেও হত্যা সংশ্লিষ্ট চারটি কারণ উদঘাটনে কাজ করছে। সেই কারণগুলো হলোÑ হত্যাকা-ে কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে, হত্যার ঘটনাস্থল, কেন এই হত্যাকা- এবং আর কারা জড়িত।
তবে, মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এটা একটি পরিকল্পিত হত্যাকা-। পরিকল্পনা মতো ঘাতক পিন্টু তার ভাড়া বাসায় নিয়ে ওই রাতেই প্রবীরকে হত্যা করে। পরে হয়তো লাশ বাড়ির বাইরে নিয়ে গেলে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় লাশ কেটে টুকরো টুকরো করা হয় এবং তিনটি সিমেন্টের ব্যাগে ভরে লাশ গুমের জন্য বাড়ির সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেয়। তবে, কিলাররা প্রফেশনাল না হওয়াতে এমন কাজ করেছে। কারণ সেফটিক ট্যাংকে লাশ ফেলার কারণে যেকোনো সময় দুর্গন্ধ ছড়াবে এবং তারা গ্রেপ্তার হবে। এমনটা বলেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা। তিনি আরো জানান, লাশের হাঁটুর নিম্নাংশ পাওয়া যায়নি। তা খোঁজা হচ্ছে।
এসপির সংবাদ সম্মেলন : মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মঈনুর হক বলেন, কালিরবাজারে ভোলানাথ জুয়েলার্সের মালিক প্রবীর ঘোষের হত্যার সঙ্গে তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু পিুন্ট দেবনাথ ও বাপন ভৌমিক জড়িত। তারাই নৃশংসভাবে প্রবীর ঘোষকে হত্যার পর লাশ গুমের উদ্দেশ্যে কেটে টুকরো টুকরো করে সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেয়। এরমধ্যে বাপন ভৌমিক বাবু পিন্টু দেবনাথের কর্মচারী। হত্যার পর পিন্টু দেবনাথ প্রবীর ঘোষের মোবাইল ফোনটি বাপনকে ব্যবহার করতে দেয়। পরে মোবাইল ট্র্যাকিং করে আইএমইআই নাম্বারের সূত্র ধরে প্রবীর ঘোষের মোবাইলসহ বাপনকে আটক করা হয়। তার তথ্যমতে আটক করা হয় পিন্টু দেবনাথকে। মূলত আর্থিক লেনদনের কারণেই খুন হয়ে থাকতে পারেন প্রবীর ঘোষ, প্রাথমিকভাবে এমনটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে কী কারণে প্রবীর ঘোষকে হত্যা করা হয়েছে এবং হত্যার সঙ্গে আরো কেউ জড়িত আছে কি না তা জানার চেষ্টা চলছে। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোস্তাফিজুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) ফারুক হোসেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরফুদ্দিন (সার্কেল-ক), অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিবি) নুরে আলম প্রমুখ।
স্বর্ণপট্টি বন্ধ, কালো পতাকা : এদিকে প্রবীর ঘোষের হত্যাকা-ের বিচার ও হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে কালিরবাজার স্বর্ণপট্টির সব জুয়েলারি দোকান বন্ধ রাখা হয়েছে। দোকানে-দোকানে টানানো হয়েছে কালো পতাকা। লাগানো হয়েছে ব্যানার। ব্যবসায়ীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ আর গভীর শোক বিরাজ করছে। এমন একটি ঘটনায় তারা রীতিমতো স্তব্ধ। প্রবীর ঘোষ নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তার সন্ধান চেয়ে তারা সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছেন। এ সময় স্বর্ণ শিল্পী শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি মুকুল মজুমদার বলেন, প্রবীর ঘোষের মৃত্যুতে আমরা সবাই শোকাহত। ২২ বছর ধরে আমরা এক সঙ্গে কাজ করছি। তার এমন হত্যাকা-ে আমরা হতভম্ব। এখনো সাংগঠনিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। আমাদের কারো কাজে মন নেই। তাই সাময়িকভাবে মার্কেট বন্ধ রাখা হয়েছে। তার সৎকার হলে আমরা একত্রিত হবো। তখন পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, কালিরবাজার জুয়েলারি মালিক সমিতির সভাপতি মো. শহিদুল্লা, সহ-সভাপতি মো. তুহিন, স্বর্ণ শিল্পী শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি অরুণ কুমার দত্ত, সহ-সভাপতি মুকুল মজুমদারসহ স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা।
বাড়িতে শোকের মাতম : প্রবীর ঘোষের মৃতদেহ উদ্ধারের পর থেকে তার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। ক্ষণে ক্ষণে স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠছে চারপাশের পরিবেশ। সন্তানের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে এমন সংবাদের পর থেকেই প্রায় বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন বাবা ভোলানাথ ঘোষ। কিছুক্ষণ পরপরই প্রিয় সন্তানকে খুঁজে ফিরছেন মা। মঙ্গলবার দুপুরের পর প্রবীর ঘোষের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় নিহতের স্ত্রী রূপা ঘোষের পাশে বসেই কাঁদছে ১২ বছরের মেয়ে দিয়া। ছোট মেয়ে ঐশী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মায়ের কান্নার দিকে। যখন মা কিংবা বোনকে খুব বেশি কান্না করতে দেখছে তখন সেও কেঁদে উঠছে।
দৈনিক কালের খবর নিয়মিত পড়ুন।